× প্রচ্ছদ ঈশ্বরদী পাবনা জাতীয় রাজনীতি আন্তর্জাতিক শিক্ষাজ্ঞন বিনোদন খেলাধূলা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নির্বাচন কলাম
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঈশ্বরদী খেলা প্রযুক্তি বিনোদন শিক্ষা



যে ভাবে আগুন লাগে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে

আগুন লাগার পরও টানা ৪০-৪৫ মিনিট ধরে চলতে থাকার একপর্যায়ে বিস্ফোরিত হয় এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন। সেই আগুনের সংস্পর্শে পর্যায়ক্রমে বিস্ফোরিত হয় ইঞ্জিনরুমের পাশে থাকা ক্যান্টিন এবং দোতলার চা’র দোকানের কমপক্ষে চারটি গ্যাস সিলিন্ডার। ইঞ্জিনরুমে থাকা ডিজেলের ১৩টি ব্যারেল বিস্ফোরিত হলে চোখের পলকে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয় তিনতলা লঞ্চটি। ছড়িয়ে পড়া আগুনের গতি এতটাই দ্রুত ছিল যে নিজেকে রক্ষা করার তেমন কোনো সময়ই পাননি অধিকাংশ যাত্রী। এতে ৪২ জনের নির্মম মৃত্যু ও শতাধিক মানুষ মারাত্মক দগ্ধ হন। এ ছাড়া এখনো নিখোঁজ অনেক নারী পুরুষ শিশু। রেড ক্রিসেন্টের হিসাবেই যার সংখ্যা ৫১। ইঞ্জিন বিস্ফোরণ থেকেই যে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের সূচনা তার প্রমাণ এরই মধ্যে মিলেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে লঞ্চের মালিকপক্ষের নানা গাফিলতির বিষয়ও আসছে সামনে। চলতি মাসেই লঞ্চটিতে বসানো হয় নতুন দুটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন। কাঙ্ক্ষিত গতি পেতে বসানো নতুন এই ইঞ্জিনের একটিতে শুরু থেকেই ধরা পড়ছিল নানা ত্রুটি। তার পরও এটিকে যাত্রী পরিবহণের কাজে লাগায় এর মালিক মো. হান জালাল শেখ। এমনকি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন লঞ্চটি ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে তখনো টেকনিশিয়ানরা কাজ করছিলেন ইঞ্জিনরুমে। ত্রুটি ধরা পড়ার পরও সার্ভিস থেকে না সরিয়ে যাত্রী পরিবহণে লাগানোর কারণেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল বলে ধারণা সবার। অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে শুক্রবারই ধরা পড়ে ইঞ্জিনে ত্রুটির বিষয়টি। যদিও মালিকপক্ষ শুরু থেকেই তা অস্বীকার করে আসছে। শনিবার দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ পরিদর্শনে গিয়ে তদন্ত দলগুলোর সদস্যরাও বলেছেন ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকার বিষয়ে। গতকাল অন্তত তিনটি তদন্ত দলের সদস্যরা পরিদর্শন করেন ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী তীরে নোঙ্গর করে রাখা অভিযান-১০ লঞ্চটি। একই সাথে লঞ্চটি দেখতে যান নৌপরিবহণ মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি। লঞ্চ পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে যে লঞ্চের ইঞ্জিনেই ত্রুটি ছিল।’ ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান সংস্থাটির উপ-পরিচালক জামাল উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘পরিদর্শনকালে লঞ্চে থাকা দুটি ইঞ্জিনই আমরা দেখেছি। প্রাথমিকভাবে যেটা মনে হচ্ছে একটি ইঞ্জিনের ছয়টি সিলিন্ডারের একটি বিস্ফোরিত হয়েছে।’ তদন্ত কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এসব বক্তব্যের প্রমাণ মেলে পুড়ে যাওয়া লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে। সেখানে বিস্ফোরিত হওয়া সিলিন্ডারের উপরের অংশ যে উড়ে গেছে তা স্পষ্ট। যদিও নৌমন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসান বলেন, ‘এসবই হচ্ছে প্রাথমিক ধারণা। তদন্ত চূড়ান্ত এবং রিপোর্ট তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আসলে সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না।’ দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকার বিষয়ে শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন যাত্রীরা। লঞ্চের যাত্রী বরগুনার বামনা উপজেলার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মেরামত কাজ চলতে দেখা গেছে লঞ্চের ইঞ্জিনে। বহুক্ষণ ধরে ইঞ্জিন চালু রেখে চলছিল এই মেরামত। তখনো দুটি ইঞ্জিনের একটি থেকে বেরুচ্ছিল অস্বাভাবিক শব্দ। একেবারে শেষ মুহূর্তে ইঞ্জিন ওকে বলে জানান কর্মরত টেকনিশিয়ানরা। এরপর লঞ্চ যাত্রা শুরু করলেও ইঞ্জিনের সেই অস্বাভাবিক শব্দ রয়েই যায়।’ দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বরগুনার ঢলুয়া গ্রামের কালু সিকদার জানান, ‘ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ার ঘণ্টাখানেক পরই উত্তাপ অনুভূত হতে থাকে ডেকে। বিশেষ করে দোতলার ডেকের স্টিল প্লেটে বসা কিংবা শোয়া কঠিন হয়ে পড়তে থাকে। নিচের ডেকেও বাড়তে থাকে উত্তাপ। বিষয়টি সম্পর্কে লঞ্চে থাকা স্টাফদের বললেও তারা কোনো ভ্রূক্ষেপই করেননি। একপর্যায়ে কিছু যাত্রীর উচ্চবাচ্যের মুখে স্টিল ডেকের গরম থেকে বাঁচাতে আলাদা ম্যাট বিছিয়ে দেওয়া হয়।’ আরেক যাত্রী বেতাগীর রাসেল মিয়া জানান, ‘ভিড়ের কারণে উপরে জায়গা না হওয়ায় নিচের ডেকেই ছিলাম। পুরোটা সময় ইঞ্জিনরুমে অপারেটর ছাড়াও কয়েকজনকে খুঁটিনাটি কাজ করতে দেখেছি। খানিকটা চিন্তাগ্রস্তও মনে হয়েছে তাদের। দপদপিয়া ঘাট ছাড়ার পরপরই একটি ইঞ্জিন থেকে মাঝে মধ্যেই আগুনের ফুলকি বের হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে আওয়াজও বদলে যায়। বিকট শব্দ বের হতে থাকে ইঞ্জিনটি থেকে। এভাবে আরও ৪০-৪৫ মিনিট চলার পর হঠাৎই বিকট শব্দ আসে ইঞ্জিন রুম থেকে। তার পরপরই দেখি আগুনে ছেয়ে গেছে চার পাশ।’ ইঞ্জিনে ত্রুটির বিষয়ে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে লঞ্চেরই একাধিক কর্মীর কাছ থেকে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তারা জানান, ‘করোনা মহামারি শুরুর মাত্র ক’দিন আগে নির্মাণ সম্পন্ন হয় এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের। নির্মাণ শেষে লঞ্চে দুটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন বসায় মালিক। মহামারির কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় বসে থাকতে হয় লঞ্চটিকে। পরে ঢাকা-বরগুনা রুটে যাত্রী পরিবহণে নামে অভিযান-১০। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গতি না পাওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে হতে থাকে দেরি। প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়তে থাকে অভিযান। একপর্যায়ে লঞ্চের দুটি ইঞ্জিনই বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন এর মালিক। সে অনুযায়ী চলতি মাসের গোড়ার দিকে ভিন্ন দুটি রিকন্ডিশন্ড ডাইহাটসু ইঞ্জিন বসানো হয় লঞ্চে। শুরু থেকেই এর একটি ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে। দফায় দফায় মেরামত করেও সমাধান হচ্ছিল না সমস্যার। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, প্রায় প্রতি ট্রিপেই লঞ্চে থাকত টেকনিশিয়ান। যাত্রা পথে কোনো সমস্যা হলে মেরামত করত তারা। বৃহস্পতিবার বিকালেও ত্রুটি দেখা দেয় ইঞ্জিনে। কোনোভাবে মেরামত করে বরগুনার উদ্দেশে ঘাট ছাড়ে লঞ্চটি। এরপর ভোর ৩টা নাগাদ ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। লঞ্চে থাকা কেবিন বয় ইয়াসিন জানায়, ‘ইঞ্জিনরুমের পাশেই থাকা ক্যান্টিনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন ছড়িয়ে যায় পুরো লঞ্চে। রেলিংয়ে থাকা মোটা পর্দায় লেগে আগুন দোতলায় উঠলে সেখানে চা’র দোকানের গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়। আগুন ধরে যায় কাঠের সিলিংসহ কেবিনের ডেকোরেশনে থাকা কাঠসহ দাহ্যবস্তুতে। এরপর আর আগুন নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় ছিল না।’ লঞ্চ কিংবা ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এমনটা শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছেন এর মালিক মো. হান জালাল শেখ। নতুন দুটি ইঞ্জিন বসানোর কথা স্বীকার করলেও সেগুলোতে কোনো ত্রুটি ছিল না বলে দাবি তার। নতুন ইঞ্জিন লাগানোর পর ঢাকা-বরগুনা রুটে মাত্র চারটি ট্রিপ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাত ৩টা ৫ মিনিটে লঞ্চে থাকা কেরানী আনোয়ার প্রথম ফোন করে আমায় আগুনের কথা জানায়। সে আমাকে জানায় যে দোতলায় একটি বিস্ফোরণের পর পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ইঞ্জিন তো নিচতলায়। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকলে তো বিস্ফোরণ নিচতলায় হওয়ার কথা। সম্ভবত কোনো যাত্রীর অসচেতনতার কারণে এই আগুনের সূত্রপাত। ক্যান্টিন থেকেও হতে পারে।’ লঞ্চে ইঞ্জিন মেরামতের টেকনিশিয়ান থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। যেখানে ইঞ্জিন আছে সেখানে টেকনিশিয়ান তো থাকবেই। তা ছাড়া লঞ্চে আমি যে ইঞ্জিন বসিয়েছি তা তো আর একপিস নয়। দেশের প্রায় সব ডবলডেকার লঞ্চেই এই ইঞ্জিন। আগুন কেন লেগেছে তা বোঝা যাবে তদন্ত কমিটিগুলোর রিপোর্ট আসার পর। তার আগেই যদি আপনারা বলে দেন যে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয়ে আগুন লেগেছে সেটা তো আর হবে না।’ Advertisement (madimart)
Advertisement (sandha)
A
dvertisement (pabna sweet)
Advertisement (school)

No comments