এক রাজা ও নরসুন্দরের গল্প
আশীষ কুমার দে
প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে গিরিজা প্রসাদ নামে এক রাজা ছিলেন। তখন রাজপরিবারের জন্য নির্দিষ্ট জ্যোতিষী (গণক ঠাকুর), পুরোহিত, নরসুন্দর (নাপিত) ও ধোপা থাকতো। গিরিজা প্রসাদেরও একজন বেতনভুক্ত নাপিত ছিলেন; নাম কৃষ্ণপদ শীল (কেষ্ট)। আর গণক ঠাকুরের নাম ছিল জানকীনাথ আচার্য। রাজা মহাশয় খুবই ধর্মপরায়ণ এবং দয়ালু ছিলেন। কাউকে কোনো কথা দিলে সে কথা নড়চড় হতো না।
কেষ্ট প্রতিদিন ভোরে রাজবাড়িতে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে রাজার ক্ষৌরকাজ করতেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে কিছু কথোপকথনও হতো। একদিন তিনি এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিলেন রাজা গিরিজা প্রসাদকে।
কেষ্ট: আমি একটা কথা বলবো রাজা মহাশয়?
গিরিজা প্রসাদ: বল।
কেষ্ট: নির্ভয়ে না সভয়ে বলবো?
গিরিজা: তুই রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও অনুগত নাপিত। আর আমি রাজা। তুই যেকোনো কথাই নির্ভয়ে বলতে পারিস আমাকে।
কেষ্ট: আমি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাই। Advertisement
এ কথা শুনে গিরিজা প্রসাদ তো হতভম্ব। কিন্তু একেতো ধর্মপরায়ণ, তার ওপর নির্ভয়ে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই নাপিতের কথায় প্রচণ্ড রাগ হলেও তা সংবরণ করে নিশ্চুপ রইলেন।
সন্ধ্যায় রাজদরবারে ডাক পড়লো জ্যোতিষী জানকীনাথ আচার্যের। রাজা মহাশয় তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বললেন।
গিরিজা প্রসাদ: জ্যোতিষী বাবু, কেষ্ট আমার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও অনুগত নাপিত। বেয়াদবি তো দূরের কথা, আমার সামনে কখনো মাথা তুলেও কথা বলে না। কিন্তু আজ সকালে সে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাইলো। এর রহস্যটা কি?
জানকীনাথ: (কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর....) রাজা মহাশয়, আপনি কি প্রতিদিন একই স্থানে বসে ক্ষৌরকাজ করান?
গিরিজা প্রসাদ: হ্যাঁ। শুরু থেকেই বাড়ির ভেতরের পুকুরটার পূর্বপাশে বসে করাতাম। তবে আজই প্রথম একই পুকুরের পশ্চিমপাশে বসে করিয়েছি।
জানকীনাথ: আগামীকাল পুকুরের পূর্বপাশে (আগের স্থান) বসে ক্ষৌরকাজ করাবেন এবং নাপিত কোনো বেয়াদবি করলেও আপনি ওকে কিছুই বলবেন না। আমি কাল সন্ধ্যায় এসে আবারো খোঁজ নেবো।
জ্যোতিষী (গণক ঠাকুর) জানকীনাথ পরের দিন সন্ধ্যায় যথারীতি রাজদরবারে এলেন এবং রাজা মহাশয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বললেন।
জানকীনাথ: কেষ্ট নাপিত কি ফের রাজকন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?
Advertisement
গিরিজা প্রসাদ: না, কেষ্ট আজ আগের মতোই চুপচাপ থেকে ক্ষৌরকাজ সম্পন্ন করেছে।
জানকীনাথ: তাহলে আগামী দিন আপনি পুনরায় পুকুরের পশ্চিমপাশে ক্ষৌরকাজ করাবেন এবং নাপিতের সব কথা শুনবেন। কিন্তু বেয়াদবি করলেও উত্তেজিত হবেন না।
গিরিজা প্রসাদ: আচ্ছা, জ্যোতিষী বাবু।
পরেরদিন সকালে রাজা তাঁর ক্ষৌরকাজের জন্য কেষ্ট নাপিতকে নিয়ে রাজবাড়ির ভিতরের পুকুরের পশ্চিমপাশে গেলেন। কেষ্ট তাঁর কাজ শুরু করলেন এবং কাজের ফাঁকে কথাও বলতে লাগলেন।
কেষ্ট: আপনাকে একটা কথা বলবো রাজা মহাশয়?
গিরিজা প্রসাদ: বল।
কেষ্ট: সভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে?
গিরিজা: তুই আমার বেতনভুক্ত নাপিত। আমাকে যেকোনো কথাই তুই নির্ভয়ে বলবি।
কেষ্ট: রাজা মহাশয়, আপনার মেয়েটাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন?
নাপিতের কথা শুনে রাজা গিরিজা প্রসাদ চুপচাপ রইলেন।
সন্ধ্যায় গণক জানকীনাথ রাজদরবারে এসে রাজার মুখ থেকে সব শুনে বললেন, “রাজা মহাশয়, পুকুরের পশ্চিমপাশে যেখানে দাঁড়িয়ে কেষ্ট আপনার ক্ষৌরকাজ করে সেখানে মাটির নিচে স্বর্ণমূদ্রা ও মনিমুক্তা আছে। এই ধনসম্পদের গরমে (অহংকার) কেষ্ট নাপিত সব ধরনের শিষ্টাচার ভুলে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাইছে।
জ্যোতিষীর মুখে এ কথা শোনার পর রাজা মহাশয় ওই স্থান খোঁড়ার ব্যবস্থা করতে পারিষদবর্গকে নির্দেশ দিলেন। এরপর তাৎক্ণণিকভাবে সেখানে মাটি খুঁড়ে প্রচুর ধনরত্ন পাওয়া গেলো।
মর্মবাণী: অর্থসম্পদ বা ধন-দৌলত চিরস্থায়ী নয়। তবুও এর অহংকার মানুষকে দিনদিন বিবেকহীন, রুঢ় আর অমানুষ করে তোলে। তবে সবাইকে নয় ......।
ঢাকা। তারিখ: ২৩.০৭.২০২১
লেখক: সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও অধিকারকর্মী।
No comments